ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বৈঠক

দেশের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্বের প্রশ্নে ঐকমত্য

ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় : ০৪-১২-২০২৪ ০৮:৫৫:০১ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৪-১২-২০২৪ ০৮:৫৫:২৯ অপরাহ্ন
দেশের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্বের প্রশ্নে ঐকমত্য ​সংবাদচিত্র : সংগৃহীত
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের আলোচনায় মূল সূর ছিল, আমাদের মধ্যে মত-পথ-আদর্শ ভিন্ন থাকবে। রাজনীতিতে ভিন্ন থাকবে। দেশ, সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্বের প্রশ্নে আমরা সবাই এক। সবার উপরে দেশ। আমরা এটা থেকে কখনও পিছু হবো না। বৈঠক শেষে  বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বিফ্রিংয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলছিলেন আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। 
তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, ভারতের এই সমস্ত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের আত্মমর্যাদাশীল ও সাহসী ভূমিকার প্রসংশা করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারের সাথে তারা একাত্মতা প্রকাশ করেছে। একইসাথে এ সমস্ত প্রচারণার বিরুদ্ধে সরকারকে আরও শক্তিশালী ও বেগবানভাবে কাজ করার কথা বলেছে। এজন্য প্রবাসী, বন্ধু রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের ডেকে আনতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আমাদের কমিউনিকেশন ও লিগ্যাল স্কিল বাড়াতে বলা হয়েছে। 
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সাথে যত চুক্তি হয়েছে, সেগুলো প্রকাশের দাবি এসেছে বৈঠকে। রামপালসহ যেসব চুক্তি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর, সেগুলো বাতিলের দাবিও তোলা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের প্রতি অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্যের চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টায় নিন্দা জানানো হয়েছে। ভারতকে বাংলাদেশের প্রতি মর্যাদাশীল ও প্রতিবেশিসুলভ আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ভারত বাংলাদেশবিরোধী যেসব অপপ্রচার চালাচ্ছে, সেগুলো মোকাবেলায় সকল সম্প্রদায়ের মানুষের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে বৈঠকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি যেকোনো উসকানির মুখে অটুট রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সবশেষে সবাই একটা জিনিস বলেছেন, আমাদেরকে শক্তিহীন-নতজানু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। যেকোনো অপপ্রচার ও উসকানির বিরুদ্ধে অটুট থাকবো। আমরা ঐক্য থাকবো। আমরা সাহসী থাকবো। ভবিষ্যতেও কোনো অপপ্রচার ও উসকানি এলে আমরা আমাদের ঐক্যকে আরও বেগবান দেখানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখবো। ভারতের অপপ্রচারণার বিরুদ্ধে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, তাই সবাই মিলে একটি সমাবেশ, কাউন্সিল করতে পারে কি না তেমন একটি প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছেন আসিফ নজরুল। 
সংলাপের সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা যে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে সেটি ধামাচাপা দিয়ে ‘আরেক বাংলাদেশের’ কাহিনী রচনার অপচেষ্টা চালানোর কথা তুলে ধরে বলেন, এটা যে শুধু এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে তাও নয়। বিশেষ বিশেষ বড় বড় দেশের মধ্যে এটা ছড়িয়ে গেছে। আমাদের বিরাট অভ্যুত্থানটা তাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটা মুছে দিতে চায়, আড়াল করতে চায়। এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায় যেন- আমাদের এখানে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়ে গিয়েছে সেখান থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। 
সংলাপের শুরুতে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে ইউনূস বলেন, সেটা মিথ্যা প্রমাণ করা, বাস্তবকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবার এক জোট হতে হবে। এটা কোন বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের কিছু না, জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্বে বিষয়। নানা দিক থেকে তারা একটা কাল্পনিক বাংলাদেশ তৈরি করেছে দুনিয়ার সামনে, তাদের শক্তি এত বেশি। ক্রমে ক্রমে তারা মানুষকে এটাতে ভেড়াতে পারছে, এই যে নতুন কল্পকাহিনী তারা তৈরি করছে। তা নিয়ে অনেকে সন্দেহও প্রকাশ করেছে-এখানে কি ধরনের সরকার হয়েছে। তাদের কী আমার বাধা দিয়েছি আসতে? আমরা তাদের বলেছি, আসেন দেখে যান। এখানে কোন বাধা নাই। কিন্তু তারা ওখান থেকে কল্পকাহিনী বানিয়ে যাচ্ছেন। 
অপপ্রচার ঠেকাতে সবাইকে একজোট হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন আমাদের সারা দুনিয়াকে বলতে হবে আমরা এক। আমরা যে পেয়েছি তা এক যোগে পেয়েছি। কোনো মতভেদের মধ্যে পাইনি। কাউকে ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি। যারা আমাদের বুকের ওপর চেপেছিল তাদেরকে আমরা বের করে দিয়েছি। আমার নিজেরাই উন্মুক্ত হয়েছি। সে জিনিসটা সবার সামনে তুলে ধরা। কীভাবে তুলবো এ ব্যাপারে পরামর্শৃ সবাই মিলে যেন আমরা এটা করতে পারি। তিনি বলেন, কারণ নতুন বাংলাদেশের যাত্রা পথে এটা একটা মস্তবড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বে বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জিনিস আমাদের মনের ভেতর যেটা আছে সেটা সবার সামনে একত্রিত হয়ে বললে আমাদের শক্তি সমবেত শক্তি হিসাবে আসবে। 
ঐক্যমত্য চায় বিএনপি, সঙ্গে নির্বাচনী রোডম্যাপও 
নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশ হয়ে গেলে আর ষড়যন্ত্র করার সাহস কেউ পাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করা হয়েছে, তাদের ষড়যন্ত্রকেও এ দেশের ছাত্র-জনতা সবাই মিলে আমরা মোকাবিলা করব। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে হওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। 
খন্দকার মোশাররফ বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের ইস্যু তৈরির বিষয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের সহযোগিতা চাওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এই ডিসেম্বরে লাখো মানুষের শাহাদাতের বিনিময়ে গণতন্ত্রের জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এবং দেশের শান্তি শৃঙ্খলার জন্য স্বাধীনতা পেয়েছে। এই বিজয়ের মাসে আমাদের সবার প্রত্যয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের দায়িত্ব এই দেশে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে পতিত সরকার বিদেশ থেকে যে ষড়যন্ত্র করছে সেই ফ্যাসিস্ট, পতিত সরকারের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন। 
দু-এক দিনের মধ্যে সুখবর আসছে: জামায়াতের আমির
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপ শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমি থেকে বেরিয়ে সংলাপের বিষয়ে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, অপপ্রচার মোকাবিলায় আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করবো। তিনি আরও বলেন, আমরা কারও পাতা ফাঁদে পা দিব না। কারও কাছে মাথা নত করবো না, আবার সীমা লঙ্ঘনও করবো না। দুই একদিনের মধ্যে সুখবর পাবেন আশা করি। সরকারকে সহযোগিতা করছেন জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে আমরা ঐক্যবদ্ধ। সরকার যাতে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়, সেটার জন্য আমরা সহযোগিতা করবো। জামায়াতের আমির বলেন, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে বিজয় এসেছে, চলমান ষড়যন্ত্রও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করবো। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। 
তিন বিষয়ে মতামত চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা : আসাদুজ্জামান ফুয়াদ
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিনটি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে বৈঠকের বিরতির সময় ফরেন সার্ভিস একাডেমি থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রথম বিষয় ভারতসহ সারাবিশ্বে যে প্রোপাগান্ডা চলছে সেগুলো নিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয়; দ্বিতীয় বিষয় আগরতলায় সহকারী হাইকমিশন অফিস ভাঙচুর ও পতাকা অবমাননা নিয়ে করণীয় এবং তৃতীয় বিষয় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে গল্প ও উপন্যাস সারা দুনিয়ায় চলছে তা নিয়ে মতামত জানতে চেয়েছেন তিনি। এ সময় বৈঠকের এজেন্ডা সরকারের পক্ষে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান তুলে ধরেন বলেও জানান তিনি। 
আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, আজকের বৈঠকে নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা ছিল না। সবগুলো দল তাদের মতামত তুলে ধরছেন রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয় কি। এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যে আলোচনা হয়েছে তা হলো- বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আজকের আলোচ্য সূচনায় নির্বাচন না থাকলেও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেয়ার জন্য তাগাদা দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সেবার ঘাটতি সারাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে সরকার কী ব্যবস্থা নিবে। সবাই রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করেছেন স্বাধীনতা ও সাবভৌমত্বের প্রশ্নে এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমরা আপনাদের পিছনে আছি। আপনাদের সিদ্ধান্ত ও লড়াইয়ের পিছনে আমরা অংশীদার। তিনি বলেন, দুই-একজন পরামর্শ দিয়েছেন সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে আমরা একটি জাতীয় কমিশন করতে পারি কি না। জাতীয় কমিশন করলে ৫০ বছরের বঞ্চনা বিশেষ করে গত ১৬ বছরে যে বঞ্চনা হয়েছে তার সত্যতা কতটুকু তা বের হয়ে আসবে, এমন মতামতও কেউ কেউ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।  
সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার সঙ্গে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন। দলের আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি দলে ছিলেন নায়েবে আমির মজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম। এছাড়া নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি(এনপিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), গণঅধিকার পরিষদ(জিওপি) নেতারাও সংলাপে যোগ দিয়েছেন। 


বাংলাস্কুপ/ ডেস্ক/ এএইচ/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ